গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের কারণ ও প্রতিরোধে করণীয়
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। গ্যাস পাইপলাইনের লিকেজ এবং অবৈধ সংযোগগুলি এই বিস্ফোরণের প্রধান কারণ। সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এর মত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রায়শই পাইপলাইনের লিক থেকে বিস্ফোরণ ঘটছে। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে ঢাকার গুলিস্তানে একটি বড় বিস্ফোরণে ১৭ জন নিহত এবং ১৪০ জনের বেশি আহত হন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়, ভবনের বেজমেন্টে জমা হওয়া গ্যাসই বিস্ফোরণের কারণ ছিল।
ঢাকা, নরসিংদী এবং নারায়ণগঞ্জে গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা বেশি দেখা যায়। ২০২২ সালে নারায়ণগঞ্জে ১০৪টি গ্যাস বিস্ফোরণ ঘটে, যার মধ্যে অধিকাংশ পাইপলাইনের ত্রুটি এবং গ্যাস সিলিন্ডারের কারণে হয়েছে। গত তিন বছরে এসব ঘটনার ফলে সেখানে ৮২ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
গ্যাস লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের কারণ, প্রতিকার, প্রতিরোধ, এবং সচেতনতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশে, কারণ এখানে অনেক বাসাবাড়ি ও বাণিজ্যিক স্থাপনায় প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হয়। নিচে এই বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
কারণ:
১. গ্যাস পাইপলাইনের ত্রুটি: পুরনো বা নিম্নমানের গ্যাস পাইপলাইন থেকে লিকেজ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
২. গ্যাস লাইন বা চুলার অনিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ: অনেক সময় চুলা বা গ্যাস লাইন দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার বা মেরামত না করার ফলে লিকেজ দেখা দিতে পারে।
৩. লিকেজ শনাক্ত করতে ব্যর্থ হওয়া: অনেক ক্ষেত্রে গ্যাস লিকেজের প্রাথমিক লক্ষণ (যেমন গন্ধ) বুঝতে না পারা, যা সময়মত ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ হতে পারে।
৪. অনিরাপদ গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার: কম মানের গ্যাস সিলিন্ডার বা ভুল সংযোগ বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে।
৫. ইলেকট্রিক স্পার্ক বা খোলা আগুন: লিকেজের সময় ইলেকট্রিক স্পার্ক বা খোলা আগুন থাকলে বিস্ফোরণের ঝুঁকি থাকে।
প্রতিকার:
১. নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ: গ্যাস লাইন এবং চুলা নিয়মিত পরিদর্শন করা, পুরনো পাইপলাইন ও সংযোগগুলো পরীক্ষা করে মেরামত করা।
২. গ্যাস ডিটেক্টর ব্যবহার: ঘরের গ্যাস লিকেজ শনাক্ত করার জন্য গ্যাস ডিটেক্টর ইনস্টল করা।
৩. ভালো মানের উপকরণ ব্যবহার: গ্যাস লাইন ও সিলিন্ডার ইনস্টলেশনে ভালো মানের উপকরণ ব্যবহার করা।
৪. দ্রুত প্রতিক্রিয়া: লিকেজের গন্ধ পাওয়া মাত্রই গ্যাসের মূল লাইন বন্ধ করা এবং ঘরের দরজা-জানালা খুলে দেওয়া।
৫. সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ: লিকেজ হলে তৎক্ষণাৎ সংশ্লিষ্ট গ্যাস কর্তৃপক্ষ বা ফায়ার সার্ভিসের সাথে যোগাযোগ করা।
প্রতিরোধ:
১. ইনস্টলেশনে পেশাদারী সহযোগিতা: গ্যাস লাইন বা সিলিন্ডার সংযোগে প্রশিক্ষিত মেকানিক দ্বারা কাজ করানো।
২. সচেতন ব্যবহার: চুলা ব্যবহারের পর গ্যাসের লাইন বন্ধ করা এবং ব্যবহারকালীন সতর্ক থাকা।
৩. বাড়ির সঠিক বায়ু চলাচল: পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের জন্য ঘরে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা রাখা।
৪. গ্যাসের গন্ধ শনাক্ত করার প্রশিক্ষণ: পরিবার ও কর্মচারীদের গ্যাস লিকেজের গন্ধ চেনার এবং কীভাবে নিরাপদে কাজ করতে হবে সে সম্পর্কে সচেতন করা।
৫. ইলেকট্রিক ডিভাইস থেকে দূরত্ব বজায় রাখা: চুলা বা গ্যাস সিলিন্ডারের আশেপাশে বৈদ্যুতিক ডিভাইস না রাখা।
সচেতনতা:
১. গণমাধ্যম প্রচারণা: টিভি, রেডিও এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় গ্যাস লিকেজ সম্পর্কিত সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো।
২. প্রশিক্ষণ কর্মসূচি: স্কুল, কলেজ, এবং কমিউনিটি লেভেলে গ্যাস ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন।
৩. পরিবারের সদস্যদের অবহিত করা: ঘরে প্রতিটি সদস্যকে গ্যাস লিকেজের লক্ষণ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত করা।
৪. সাবধানতা সম্পর্কিত নির্দেশিকা: প্রতিটি বাসা এবং কর্মস্থলে গ্যাস লিকেজ সংক্রান্ত নির্দেশনা থাকা।
বাংলাদেশে অনেক বাড়িতে প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইন সংযোগ রয়েছে, যা প্রায়ই পুরনো এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে লিকেজের ঝুঁকিতে থাকে। এছাড়াও, এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার সঠিক সংযোগ এবং ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে নজরদারির বাইরে থাকে। সচেতনতা এবং নিরাপত্তা নির্দেশিকা পালন করা অত্যন্ত জরুরি, বিশেষত শহরাঞ্চলে, যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি এবং অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণ হলে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।
Comments