ফ্যাসিবাদ!

ফ্যাসিবাদ ও উৎপত্তি:

ফ্যাসিবাদ হল একটি কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক আদর্শ, যা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের উপর কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এর উৎপত্তি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপে ঘটে। মূলত, ফ্যাসিবাদ শব্দটি এসেছে ইটালির "ফ্যাসিও" শব্দ থেকে, যার অর্থ একটি দল বা গোষ্ঠী। ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের প্রথম নেতৃত্ব দেন ইতালির বেনিতো মুসোলিনি। এই আদর্শটি দ্রুত জার্মানি, স্পেন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।  

যুগে যুগে ফ্যাসিবাদ ও পতন: 

ফ্যাসিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য হল একটি দল বা নেতার একক নিয়ন্ত্রণ এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তি। ফ্যাসিবাদী সরকার বা শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হলো কেন্ধ্রীয়কৃত  ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব, গণমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক বিরোধিতার প্রতি কঠোর দমন,  শক্তিশালী জাতীয়তাবাদ ও সামরিকবাদের প্রভাব।জার্মানি, স্পেন, এবং অন্যান্য কিছু দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এই ধরনের শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, যখন মিত্রশক্তির বিজয়ের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী সরকারগুলোকে পরাজিত করা হয়। 
ফ্যাসিবাদের পরিণতি সাধারণত ধ্বংসাত্মক হয়। এটি রাষ্ট্রের ভেতরে এবং বাইরে সহিংসতা সৃষ্টি করে, মানুষকে বিভাজিত করে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। ইতিহাসে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা গুলোর পতন ঘটে সাধারণত জনরোষ, অর্থনৈতিক পতন, এবং আন্তর্জাতিক বিরোধিতার কারণে। ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর পরিণতি সাধারণত ধ্বংসাত্মক ও করুণ হয়েছে। ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা গুলোর পতন ও পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে নিম্নলিখিত উদাহরণ গুলি উল্লেখযোগ্য: 

১. ইতালির ফ্যাসিবাদ (বেনিতো মুসোলিনি): 

ইতালিতে ১৯২২ সালে বেনিতো মুসোলিনি ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনকালে ইতালি সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাৎসি সরকারের সাথে মিত্র হিসেবে জড়িয়ে পড়ে। মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা সমাজের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার সীমিত করে দেয়, অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে এবং জনগণের মাঝে চরম হতাশা তৈরি করে। 

পরিণতি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির পরাজয় এবং দেশটির অভ্যন্তরে বিদ্রোহের কারণে মুসোলিনির শাসনের পতন ঘটে। ১৯৪৫ সালে মুসোলিনিকে বন্দী করে হত্যা করা হয়, এবং তার লাশ জনসমক্ষে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এর ফলে ফ্যাসিবাদী শাসনের একটি অত্যন্ত করুণ ও অপমানজনক পরিণতি ঘটে। 
২. জার্মানির নাৎসি শাসন (আডলফ হিটলার)

আডলফ হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানিতে ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদী নাৎসি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। হিটলারের ফ্যাসিবাদী আদর্শ জাতীয়তাবাদ, সামরিকবাদ, এবং ইহুদি-বিরোধী বর্ণবাদী নীতির উপর ভিত্তি করে ছিল। নাৎসি সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে এবং ইউরোপে প্রচুর ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। হিটলারের অধীনে জার্মানি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর গণহত্যা (হলোকাস্ট) চালায়, যাতে ছয় মিলিয়ন ইহুদি নির্মমভাবে নিহত হয়। 

পরিণতি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির হাতে জার্মানির চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। ১৯৪৫ সালে হিটলার আত্মহত্যা করেন, এবং নাৎসি শাসনের পতন ঘটে। ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে জার্মানি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং দেশটি বিভক্ত হয়ে যায়। 

৩. স্পেনের ফ্রাঙ্কো শাসন

১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্পেনের ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ফ্রাঙ্কোর শাসনকালে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর কঠোর দমন-পীড়ন চালানো হয়। মানুষের বাকস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয় এবং অনেক বিরোধী নেতাকে কারাবন্দী বা হত্যা করা হয়। 

পরিণতি: ১৯৭৫ সালে ফ্রাঙ্কোর মৃত্যু ঘটে, এবং স্পেন ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসে। তার শাসনের পরিণতিতে দেশটিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়, যা সমাজকে গভীরভাবে বিভাজিত করে তোলে। ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর স্পেন একটি সাংবিধানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। 

৪. চিলির পিনোচেট শাসন

১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চিলিতে অগাস্তো পিনোচেটের ফ্যাসিবাদী সামরিক শাসন চলে। এই সময়ে হাজার হাজার মানুষকে বন্দী, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। পিনোচেটের শাসন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ধ্বংস সাধন করে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ায়। 

পরিণতি: আন্তর্জাতিক চাপ এবং জনরোষের কারণে পিনোচেটকে ১৯৯০ সালে পদত্যাগ করতে হয়। তার শাসনের পরিণতিতে চিলিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়, তবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য পিনোচেটের বিচার হয় এবং তার শাসনামলে ঘটে যাওয়া গণহত্যার ক্ষত আজও চিলির মানুষদের মনে বিরাজমান। 

৫. আর্জেন্টিনার সামরিক শাসন

১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনায় সামরিক শাসন চলে, যা ফ্যাসিবাদী নীতি গ্রহণ করে। এই সময়ে, প্রায় ৩০,০০০ মানুষ নিখোঁজ বা নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক বিরোধী বা সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত ছিল। 

পরিণতি: ১৯৮৩ সালে জনরোষ এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সামরিক শাসনের পতন ঘটে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, এবং সামরিক নেতাদের বিচার করা হয়। 

৬. বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের উত্থান
বাংলাদেশে হাসিনা সরকার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত একটি নিরঙ্কুশ ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে যা বিরোধীদের গুম, দমন ও নিপীড়ন, বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ, জনগণের ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করে।

পরিণতি: অবশেষে ৫ আগস্ট, ২০২৪ সালে ছাত্র জনতার এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ সরকার এর পতন ঘটে এবং শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।

ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার করুণ পরিণতির সারমর্ম:

ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা সাধারণত অর্থনৈতিক দুরবস্থা, সামাজিক অস্থিরতা, এবং আন্তর্জাতিক বিরোধ সৃষ্টি করে। এসব শাসন সাধারণত মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘন করে এবং দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। জনগণের মুক্তি ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এসব শাসনের পতন ঘটে, তবে এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত অনেক রক্তক্ষয়ী ও বেদনাদায়ক হয়ে থাকে। 

ফ্যাসিবাদী শাসনের শিক্ষা হলো: 

এমন শাসন ব্যবস্থার উত্থান রোধে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করতে হবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে, এবং মানবাধিকার সুরক্ষিত করতে হবে।

ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সংস্কার গুলো হলো: 

*গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালীকরণ
*নাগরিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের সুরক্ষা
*শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি
*শক্তিশালী ও স্বাধীন মিডিয়ার ভূমিকা

 
বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ পুনরুত্থান রোধে প্রয়োজনীয় সংস্কার: 

*নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা
*নাগরিক সমাজ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর শক্তিশালীকরণ
*স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা 
*গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা ;এটি নিশ্চিত করার জন্য গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি এবং মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিতে হবে।

Comments

Anonymous said…
Nemesis follows hubris!

Popular posts from this blog

Benefits of Early Rising

What to Do for a Perfect Decision-Making!

Dreams!