শকুন কমা মানুষের জন্য বিপদজনক!
শকুন একটি গুরুত্বপূর্ণ পাখি যা প্রকৃতিতে মৃত প্রাণীর দেহ পরিষ্কার করতে সহায়তা করে। তারা খাদ্য শৃঙ্খলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা মৃত প্রাণীর শরীর থেকে রোগজীবাণু ছড়ানো প্রতিরোধ করে। তবে শকুনের সংখ্যা হ্রাস বা বিলুপ্তি হলে পরিবেশ এবং মানুষের জন্য বিভিন্ন বিপদ হতে পারে।
শকুনের বিলুপ্তির বিপদ:
1. পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া:
শকুন মৃত প্রাণীদের খেয়ে পরিবেশকে রোগমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। শকুন না থাকলে এসব মৃতদেহ পচে গিয়ে বায়ু, পানি ও মাটিকে দূষিত করতে পারে।
2. রোগের বিস্তার:
শকুন বিলুপ্ত হলে মৃত প্রাণী অন্যান্য ক্ষতিকারক প্রাণী যেমন কুকুর বা ইঁদুর খেতে শুরু করতে পারে, যা জলাতঙ্কসহ নানা রোগ ছড়াতে পারে। এতে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়।
3. পরিবেশগত ঝুঁকি:
শকুন মারা গেলে খাদ্য চেইনের উপরে নিচে প্রভাব পড়ে, যা অন্যান্য প্রাণীর সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়, ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়।
শকুন বিষয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা ও ফলাফল:
আমেরিকান ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে বিপুলসংখ্যক শকুনের মৃত্যুর ফলে মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য সংক্রমণ ছড়িয়ে পাঁচ বছরে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গরুসহ পচাগলা প্রাণিদেহ খেয়ে ঐতিহ্যগতভাবে শকুন প্রকৃতিকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সহায়তা করত।
গবেষণাটির সহলেখক ইয়াল ফ্রাংক যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যারিস স্কুল অব পাবলিক পলিসি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করে শকুন। আমাদের পরিবেশ থেকে ব্যাকটেরিয়াসহ বিভিন্ন জীবাণু বহনকারী মৃত প্রাণী অপসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পাখিটি। এই শকুনের উপস্থিতি ছাড়া রোগজীবাণু ছড়াতে পারে। তারা শুধু দেখতেই সুন্দর না, পরিবেশের জন্য দরকারিও। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রাণিজগতের সবার আলাদা দায়িত্ব আছে। ’ গবেষণাটিতে ইয়াল ফ্রাংক ও তাঁর সহলেখক অনন্ত সুদর্শন ভারতের বিভিন্ন জেলায় জীবাণুঘটিত রোগে মানুষের মৃত্যুর হারের তুলনা করেছেন। অতীতে শকুনের ব্যাপক উপস্থিতির সময়ের সঙ্গে শকুন কমে যাওয়ার পর একই এলাকার মানুষের মৃত্যুর হারের ব্যবধান বিশ্লেষণ করেছেন তাঁরা।
ভারতীয় উপমহাদেশে একসময় প্রায় সব এলাকায় বিপুলসংখ্যক শকুন দেখা যেত। কিন্তু দুই দশক আগে এ অঞ্চলজুড়ে ব্যাপক হারে শকুন মারা যেতে থাকে। অনুসন্ধানের পর এ জন্য দায়ী করা হয় গরুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ ডাইক্লোফেনাককে। ওষুধটি প্রয়োগ করা হয়েছে এমন মৃত গরুর মাংস খেয়ে কিডনি জটিলতায় ভুগে মারা যায় বহু শকুন। মারা যেতে যেতে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এক সময়ে পাঁচ কোটি থেকে শকুনের সংখ্যা শূন্যের কাছাকাছি নেমে এসেছিল। ২০০৬ সালে গবাদি পশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পর থেকে শকুনের মৃত্যু অনেকটাই কমেছে। তবে এটি ব্যবহারের ফলে অন্তত তিনটি প্রজাতির দীর্ঘ মেয়াদে ৯১ থেকে ৯৮ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, শকুন কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মৃত্যুর হারও লাফিয়ে বেড়ে গেছে। গবেষকরা দেখেছেন, ভারতের জনপদগুলোতে ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে শকুন কমে যাওয়ার কারণে বছরে বাড়তি এক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই মানুষগুলো এমন ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমিত হয়ে মারা গেছে, যেগুলো শকুন থাকলে পরিবেশ থেকে সরিয়ে ফেলত। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, শকুনের অনুপস্থিতিতে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা বেড়ে তাদের কামড়ে মানুষের জলাতঙ্ক হওয়ার হারও বেড়েছে। শূন্য দশকে এসে এ অঞ্চলে ভারতীয় শকুনের পাশাপাশি পরিযায়ী শকুনও কমে গেছে।
শকুন রক্ষার উপায়:
1. ডাইক্লোফেনাকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা: ডাইক্লোফেনাক নামক ওষুধটি পশুদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, কিন্তু শকুন এই ওষুধ দ্বারা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তাই এই ওষুধের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
2. সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন: শকুনের প্রজনন ও আবাসস্থল রক্ষা করতে সংরক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করা এবং শকুনকে উপযুক্ত পরিবেশে ছাড়ার ব্যবস্থা করা উচিত।
3. সচেতনতা বৃদ্ধি: শকুনের গুরুত্ব সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা জরুরি, যেন তারা শকুন হত্যা বা তাদের আবাসস্থল ধ্বংস না করে।
4. প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎস সংরক্ষণ: শকুন যাতে পর্যাপ্ত খাদ্য পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ, তাদের খাদ্য শৃঙ্খলের সঠিক ব্যবস্থাপনা করা জরুরি।
শকুনের সংরক্ষণ প্রকৃতি ও মানব স্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই শকুন সংরক্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
Comments