ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব: প্রতিকার ও প্রতিরোধ
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বিশেষত বর্ষাকালে ডেঙ্গু মশার বংশবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়ায় এর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এডিস মশা পরিষ্কার ও স্থির পানিতে ডিম পাড়ে, যা বর্ষাকালে প্রচুর জমে থাকে এবং মশার প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।
ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের কারণ:
১. শহরাঞ্চলে অপর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা: বিশেষ করে ঢাকা শহরের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে পানি নিষ্কাশনের সমস্যার কারণে বৃষ্টির পানি জমে থাকে, যা এডিস মশার বংশবৃদ্ধির উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।
২. পরিস্কার পানির জমা: টব, বালতি, পরিত্যক্ত টায়ার, এবং ছাদে বা আশেপাশে জমে থাকা পানি ডেঙ্গু মশার প্রজননের অন্যতম কারণ।
৩. তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বৃদ্ধি: গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ু এবং আর্দ্রতার কারণে মশা আরও দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়।
৪. জনসংখ্যার ঘনত্ব: বাংলাদেশে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি। এর ফলে ডেঙ্গু সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ডেঙ্গুর অবস্থা:
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বিশেষ করে ২০১৯ সাল থেকে গুরুতরভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালের ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ, যেখানে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয় এবং কয়েকশো মানুষ প্রাণ হারায়। এরপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে চলেছে। ২০২৩ এবং ২০২৪ সালেও বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক ছিল, এবং এটি এখনো একটি চলমান সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।
ডেঙ্গু কি ও এর কারণ:
ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত রোগ, যা প্রধানত এডিস মশার কামড়ে ছড়ায়। এটি ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
ডেঙ্গুর কারণ:
১. এডিস মশা: ডেঙ্গু ভাইরাস সাধারণত এডিস ইজিপ্টি এবং এডিস এলবোপিকটাস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এ মশাগুলো দিনের বেলায়, বিশেষ করে সকালে এবং সন্ধ্যার সময় বেশি সক্রিয় থাকে।
2. সংক্রমিত ব্যক্তি: মশা ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে কামড়ানোর পর সেই মশা যখন অন্য কাউকে কামড়ায়, তখন নতুন ব্যক্তির মধ্যে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে।
ডেঙ্গুর প্রতিকার:
ডেঙ্গুর নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধক বা ওষুধ নেই, তবে কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে এর লক্ষণগুলো কমানো এবং রোগীর অবস্থার উন্নতি করা যায়:
১. বেশি পানি পান করা: ডেঙ্গু জ্বরের কারণে শরীর থেকে পানি বের হয়ে যায়, তাই পর্যাপ্ত পানি খাওয়া জরুরি।
২. প্যারাসিটামল গ্রহণ: জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ ডেঙ্গু জ্বরে খাওয়া উচিৎ নয়, কারণ এগুলো রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায়।
৩. বিছানায় বিশ্রাম: সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিলে শরীর দ্রুত সুস্থ হতে পারে।
৪. চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া: ডেঙ্গুতে রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে যায়, তাই নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা উচিত।
ডেঙ্গুর প্রতিরোধ:
১. মশার কামড় থেকে বাঁচা: মশারি ব্যবহার করা, দিনে এবং রাতে ফুল হাতা জামা-কাপড় পরা, এবং মশা তাড়ানোর লোশন বা স্প্রে ব্যবহার করা। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখা বা মশারির জাল ব্যবহার করা।
২. মশার প্রজনন স্থল ধ্বংস করা: আশেপাশে জমে থাকা পানি নিষ্কাশন করা, কারণ এডিস মশা সাধারণত জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে।
৩. বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা: যে সব স্থানে পানি জমে থাকতে পারে যেমন- টায়ার, পাত্র, ফ্রিজের নিচের ট্রে, ফুলের টব, ইত্যাদি পরিষ্কার করা। বাথরুম, রান্নাঘর, এবং অন্যান্য জায়গায় জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করা।
৪. ব্যক্তিগত সুরক্ষা: পুরো হাত ও পা ঢাকা পোশাক পরিধান করা। মশার প্রতিরোধক ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করা।
৫. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা: ঘরবাড়ি ও আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা। ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা এবং নিয়মিত পরিষ্কার করা।
৬. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: ডেঙ্গুর লক্ষণ ও প্রতিরোধ সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
Comments